ভূমিকা :
মুজিব নামেই হৃদয় মাঝে ভেসে আসে সুর
সকল দেশের সেরা বলে লাগে সুমধুর।
অত্যাচারী হানাদারের করতে পরাজয়
মুজিব নামেই বুকের ভেতর রক্তধারা বয়।
পাকিস্তান সরকারের শাসন এবং শােষণে যখন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জর্জরিত তখন জাতিকে মুক্তির পথ দেখাতে এগিয়ে এসেছিলেন এক অবিসংবাদিত নেতা। যার মুক্তির ডাকে বাঙালিরা ঝাপিয়ে পড়েছিল সশস্ত্র সংগ্রামে,যার দেখানাে পথ ধরে অন্ধকার থেকে বাঙালি আলাের পথে এসেছে। আমরা পেয়েছি এক স্বাধীন রাষ্ট্র। তিনিই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
জন্ম :
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গােপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামের এক মুসলিম সম্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সায়েরা খাতুন। চার কন্যা এবং দুই পুত্রের মধ্যে শেখমুজিব ছিলেন তৃতীয়।
শিক্ষাজীবন :
৭ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন। মাধ্যমিক স্তরে পড়ার সময় তিনি চোখের দুরারোগ্য বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। ফলে কয়েক বছর তার পড়াশোনা বন্ধ থাকে। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৪ সালে আই.এ এবং ১৯৪৬ সালে বিএ পাশ করেন।
এরপর ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন কিন্তু এ কোর্স তিনি শেষ করতেপারেননি। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরা দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘট ঘােষণা করলেবঙ্গবন্ধু ঐ ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানান। তারই ফলশ্রুতিতে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিস্কৃত করা হয় এবং ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।
পরিবার:
তিনি ১৯৩৮ সালে বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে বিয়ে করেন। তাদের তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল এবং দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
রাজনীতি :
ছাত্র জীবনেই তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি ঘটে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণিরছাত্র থাকাকালীন সময়ে প্রথমবারের মতাে জেলে যান। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি তাঁর স্নেহ, আনুকূল্য ও দিকনির্দেশনায় সক্রিয় রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে এগুতে থাকেন। কলকাতায় ছাত্রজীবনে তিনি নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’, ‘নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন প্রভৃতি সংগঠনের সাথে যুক্ত হন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেলেই পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের শােষণ ও শাসন চলতে থাকে। পূর্ববাংলাকে মুক্ত করাই তখন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রধান লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময় থেকেই পাকিস্তানি শাসকদের শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। ফলে ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ পাকিস্তনি সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের তিনি যুগ্মসম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে নতুন প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয়। তিনি ১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হন। কিন্তু দেশে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে তিনি কারারুদ্ধ হন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হলে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাঙালি জাতির অধিকার ও মর্যাদার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবি আদায়ের বিপরীতে কোনঠাসা করার লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালে জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্র বিরােধী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয় । জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলার ইতিহাসে ‘মেঘনা কার্টা’ হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধু উপাধি :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষকে যেমন তার প্রাণের চেয়েও ভালবাসতেন তেমনি এদেশের মানুষও তাকে খুব ভালবাসতেন এবং সম্মান করতেন। তাইতো বাঙালি জাতি ১৯৬৯ সালে ২৩ শে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সম্মেলনে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে ঢাকার রেডকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিটি দেওয়া হয় আর এই উপাধিটি দিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ।
মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম :
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে শুরু করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন তাকে গ্রেফতার করা হবে তাই গ্রেফতারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি ঘােষণাপত্র ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান চৌধুরীর কাছে পাঠান। এ ঘােষণাপত্রটি হান্নান চৌধুরী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ । দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পাই চূড়ান্ত স্বাধীনতা। ১০ মাসের বেশি সময় জেলে বন্দী থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে সাজানোর চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধু। শুরু করছিলেন অনেক কিছু তবে আর শেষ করা হলো না। দেশটাকে আরেকবার অন্ধাকারে ডুবিয়ে দিতে ৭৫ এর ১৫ অগাস্ট ছোট্ট শিশু শেখ রাছেল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব সহ সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
উপসংহার :
বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা ও অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি তাঁর মহান আদর্শে বাঙালি জাতির জীবনে চির অম্লান হয়ে থাকবেন। তাইতাে বলা যায়, ব্যক্তি মুজিবের মৃত্যু হলেও মুজিবাদর্শের মৃত্যু নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকুক এই প্রত্যাশা সকলের মাঝে। তার স্বপ্নের সােনার বাঙলা’ রূপায়নের মাধ্যমেই তাঁর স্মৃতি অমর হয়ে থাকবে। বাংলাভাষার প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদা শঙ্কর রায় যথার্থই লিখেছেন-
“যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তােমার
শেখ মুজিবুর রহমান।”