একটা সময় ছিল, যখন আমি বুঝতাম না লাইব্রেরি মানে কি, গল্পের বই বা উপন্যাস মানে কি?
আমি শুধু জানতাম, লাইব্রেরি হলো স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বসার রুম, আর উপন্যাস বা গল্পের বই মানে হল অনেক কঠিন কঠিন লেখা যা আমার পক্ষে পড়া সম্ভব না! এবং আমি মনে করি, এই গ্রামে (সিংহেরাকাঠী) হাজার না হোক, শত না হোক অর্ধশত আসপিয়া এটাই বুঝতো। এই ধারণাটা আমার ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্তও ছিল। বলে রাখা ভালো, তখন আমার লেখাপড়ার বিষয়ে তেমন কৌতূহলও ছিল না (আলোর ফেরীর বই পড়ার আগে)।
লাইব্রেরি মূলত চার প্রকার: প্রথমত ব্যক্তিগত লাইব্রেরি, দ্বিতীয়ত পারিবারিক লাইব্রেরি, তৃতীয়ত প্রতিষ্ঠানিক লাইব্রেরি এবং চতুর্থত সর্বজনীন লাইব্রেরি।
আমি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক লাইব্রেরি মানেটা কমবেশি বুঝতাম, আর প্রতিষ্ঠানিক লাইব্রেরি বলতে বুঝতাম শিক্ষকদের বসার রুম। কিন্তু সর্বজনীন লাইব্রেরি কি সে সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই ছিল না।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় জানতে পারি আমাদের গ্রামে আলোর ফেরী পাঠাগার নামে একটি পাঠাগার আছে। যা সব শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য উন্মুক্ত। তখন জানতে পারি এই ধরনের লাইব্রেরিকে সর্বজনীন বা পাবলিক লাইব্রেরী বলে।
তার মানে সর্বজনীন লাইব্রেরি হল, “যে লাইব্রেরি সমাজের সব মানুষের পছন্দের কথা বিবেচনা করে গ্রন্থ নির্বাচন করে তাকে সর্বজনীন লাইব্রেরি বা পাবলিক লাইব্রেরি বলে”।
কিছুদিন পরে আমি আলোর ফেরী পাঠাগার থেকে একটা বই পড়তে নেই। আমি বললে ভুল হবে, কারণ বইটা নির্বাচন করে দিয়েছিল বাবুল ভাইয়া (আলোর ফেরীর প্রতিষ্ঠাতা)। আমি বই পড়তে আগ্রহী ছিলাম, তবে কি বই পড়ব তা বুঝতে পারছিলাম না। বইটির নাম ছিল ‘সবুজ ভেলভেট, লেখক জাফর ইকবাল। এই বইয়ের কাহিনীটা এত সুন্দর ছিল যে, আমার মন ছুয়ে গিয়েছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, বইটি আমি মোট ৩-৪ বার পড়েছি। পড়ার দুটি কারণ ছিলঃ প্রথমত লাইব্রেরি তখন খোলা ছিল না যে কারণে আমি তখন নতুন বই আনতে পারছিলাম না। দ্বিতীয়ত, বইয়ের কাহিনীও অনেক সুন্দর ছিল। তারপরে আস্তে আস্তে বই আনি এবং পড়ি।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, যে বয়সে একটা মানুষের শারীরিক পরিবর্তন এর পাশাপাশি মানসিকভাবেও একটা পরিবর্তন আসে, সেটা বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হতে পারে যেমনঃ কোন ছেলে বা মেয়ের প্রতি আসক্তি, বা লেখাপড়ার প্রতি আসক্তি বা অন্য যেকোনো কিছুর প্রতি আসক্ত হয়ে যেতে পারে। এই বয়সটা জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে আমি মনে করি। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর অশেষ রহমতে, আমি বইয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। যেটা আমি তখন বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝতে পারছি।
পাঠাগারের বই আমাকে এতোটুকুই সাহায্য করে ছেড়ে দেয়নি, এ বই আমাকে একাডেমিক বই পড়তে সাহায্য করেছে। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্ট বলে আমি মনে করি। তাছাড়াও সাহিত্য কি? সেটা আমাকে কমবেশি বুঝিয়েছে, উপন্যাস পড়া শিখিয়েছে। উপন্যাস পড়েও কারো মন খারাপ হতে পারে, কান্না পেতে পারে, হাসি পেতে পারে, আবার রাগও হতে পারে, কখনো কখনো লেখক এর উপর অভিমানও হতে পারে যে, সে কি পারত না হিমু আর রুপাকে এক করে দিতে। কেন সে সব সময় রুপাকে নীল শাড়ি পরিয়ে গেটের বাইরে অপেক্ষায় রেখেছে? এভাবে নানা প্রশ্ন আসে, জল্পনা কল্পনা আসে, যা একাডেমিক বই পড়ে এভাবে কল্পনা করা কখনোই সম্ভব না! তবে এর মানে এই নয় যে, একাডেমিক বই পড়া আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। একাডেমিক বইয়ের গুরুত্ব অবশ্যই আছে। সেটাও আমাদেরকে বুঝতে হবে । একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার জন্য প্রতিদিন ১০ মিনিট সময় দিলেই যথেষ্ট।
তাছাড়াও এই বাইরের বই আমাকে ভালো ব্যবহার করতে শিখিয়েছে, আমার কল্পনা শক্তিকে বৃদ্ধি করেছে কোন কিছু জানার কৌতূহল সৃষ্টি করেছে।
বলা হয়ে থাকে যে, একটি দেশকে ধ্বংস করতে গেলে ওই দেশের লাইব্রেরি গুলোকে আগে ধ্বংস করতে হয়।
‘প্রমথ চৌধুরীর’ মতে, স্কুল কলেজের থেকেও লাইব্রেরির গুরুত্ব অনেক বেশি।
অতীত ও বর্তমানের মধ্যে লাইব্রেরি একটি সেতুর মতো কাজ করে।
জ্ঞান অর্জনের পথ সাধারণত দুটিঃ প্রথমত ভ্রমণ করা, দ্বিতীয়ত বই পড়া। ভ্রমণ করা সীমাবদ্ধতা অনেক এবং কষ্টসাধ্য বিষয়। অন্যদিকে নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুসারে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারি সহজেই।
তাছাড়াও, বাড়ির পাশে যদি একটি লাইব্রেরি থাকে, তাহলে শুধু জ্ঞান অর্জন নয় বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ আমাকেই ধরা যায়, তার কারণ হচ্ছে আমি আগে মাইক্রোফোন ধরতে ভয় পেতাম, একটা ভিতি কাজ করতো, কিন্তু আমার জীবনের প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হয় এই আলোর ফেরী র মাধ্যমে। এরপর থেকে স্টেজে ওঠা নিয়ে আর কোন সমস্যা হয়নি।
তাই আমার মতে, শুধু শহরে নয়, গ্রামেও প্রত্যেক এলাকায় – এলাকায় লাইব্রেরি থাকা প্রয়োজন।
আলোর ফেরীর সামনে ও পেছনে যারা কাজ করছেন, তাদের উত্তর – উত্তর মঙ্গল কামনা করছি। এভাবে বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এবং লাইব্রেরি সম্পর্কে ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
পরিশেষে বলতে চাই, আসুন বই পড়ি একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ে তুলি।
লেখাঃআসপিয়া বিনতে লতিফ
দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী